"ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু
পথে যদি হারিয়ে..................."
সংগ্ৰামী জীবন : কথাটার তাৎপর্য বড়ই ব্যপ্ত, বিস্তীর্ণ, একে দ্বাররুদ্ধ করে রাখা যায় না আবার স্রোতের হাওয়ায় মিশিয়েও দেওয়া যায় না। তবে যার কথা ভেবে এই লেখনীকে আশ্রয় করেছি সে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয় বা তথাকথিত এন. জি. ও. তে কাজ করা কোনো সমাজসেবীও নয়। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের সামাজিক প্রেক্ষাপটেই তৈরী হয়েছিল তার সমাজে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। সে সম্বল করে নিয়েছিল তার পুঁথিগত বিদ্যা তথা শিক্ষা আর তথাকথিত আধুনিক মানসিকতাকে। পঞ্চাশের দোড়গোড়ায় তখনও আমাদের মানসিক গঠন পূর্ণতা পায়নি, "জন্মেছি যখন দাগ কেটে যাব" - এই চিন্তাধারা পোষণ করতে শিখিনি, রক্ত মাংসে গড়া মানুষ হতে চেয়েছিলাম, ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই কীভাবে যেন বেড়ে উঠেছিল এই মেয়েটি। চেয়েছিল পড়াশোনা শিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে মান - হুঁশ হতে।
উত্তরবঙ্গের কোনো এক প্রত্যন্ত চা বাগানে বড় হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট মেয়ে। সে যে নাগরাকাটার সবুজ মোড়া চা বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অর্কর মতো স্বপ্ন দেখত - স্বাধীন সমাজের। যে সমাজে থাকবেনা উচ্চ - নীচের ভেদ, চারিদিকে হাহাকার। শ্লীলতাহানী, নির্যাতন, ধর্মের নামে ভ্রষ্টামি - এরকমই দুর্বোধ্য শব্দগুলি যাবে সমাজ থেকে মুছে। কিন্তু সে যে তখন খুবই ছোট, বাবা - মায়ের হাত ছাড়া হতে পারেনি তখনও। কিন্তু বয়সে ছোট হলে কি হবে, তার মন উড়ে যেত গোর্কি, নিকোলাই অস্ত্র ভোস্কির দেশে - যেখানে একজন সাধারণ মা তার ছেলে পাভেলকে এগিয়ে দেয় রক্তে রাঙা বিপ্লবের পথে। সেই ছোট্ট মেয়েটির হাত ধরেই প্রত্যন্ত চা বাগানের একটি স্কুলের হয় গোড়াপত্তন। আর মেয়েটির জীবনের প্রথম তথা স্কুলটির প্রধান শিক্ষক তার কানে ঢুকিয়ে দেয় জীবন চলার অভয়মন্ত্র - যে অভয়বানীকে সম্বল করে সেই বাহ্যকলেবরহীন বিদ্যালয়টির মতো সেও এগিয়ে চলে জীবনযুদ্ধে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি তার জীবনরথ - সেখান থেকে উত্তরণ শহরের এক অখ্যাত বিদ্যালয়ে। একান্নবর্তী পরিবারের আর পাঁচজন ভাইবোনের সাথে মিলেমিশে থাকলেও তার স্বাতন্ত্রতা চোখে পড়তে দেরী হয় নি কারোরই। বাড়ির কাকু পিসিরা ছোটবেলাতেই তাকে আখ্যায়িত করে "দিদিমণি" নামে। যুক্তির অভাবে তৎকালীন সমাজ পরিবারের অনেক কথাই তার জীবনকে ছাঁচে ফেলে দিতে পারেনি। সেই সময়ের প্রিইউনিভার্সিটির গন্ডি পার হয়ে সে এসে দাঁড়ায় মহাবিদ্যালয়ের বিশাল প্রাঙ্গণে। তখন সে অনেক স্বাধীন। আর পাঁচটা মেয়ের মতো পুতুল খেলার সংসারে সে বিশ্বাসী নয়। ছেলের দলের সাথে পাল্লা দিয়ে সে সমাজ, সামাজিকতা, তৎকালীন প্রেক্ষাপট নিয়ে গলা মেলাতে থাকে। তার চলনবলন আচার আচরণ বুঝিয়ে দেয় নারী মাত্রই অবলা জীব নয়। পোশাকে আধুনিক না হয়ে মানসিকতাতেও আধুনিক হয়ে ওঠা যায় - তাই ছিল তার দর্শন। ষাটের দশকে প্রত্যন্ত শহরগুলিতে মেয়েদের অবস্থান কিন্তু কখনোই ছেলেদের সাথে এক সারিতে নয়। কিন্তু তাই মেয়েটি - সে তার জেদ, সাহসিকতা আর একনিষ্ঠতা দিয়ে আদায় করে নেয় নিজের স্থান। পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সে পাড়ি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে - সাথে থাকে শুধু তার অধ্যাবসায়ের মানপত্র আর মনের জোর। জড়িয়ে পড়ে সেই সময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনে। ষাটের দশকের বিপ্লবী মনোভাবকে নিজের মনের ভিতরে পেরেক দিয়ে গেঁথে নেয় - যার ফল আজও প্রতিটি ক্ষেত্রে জাজ্বল্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল তার সুপ্ত স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে আর সেও দেখতে শুরু করে স্বপ্ন। কিন্তু বাঁধ সাধে প্রকৃতি, বাঁধ সাধে সমাজ। সে যে মেয়ে, সে যে যুবতী - তাইতো তার ঘরের ঠিকানা যে অস্থায়ী, তাকেও চলে যেতে হয় ঘোমটার আড়ালে। তার দুর্ভাগ্য - মাধবীলতার মত অনিমেষকে সে পায়নি - তবে আর একধরণের কণ্টকময় পরিবেশে শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় আর দীর্ঘ অধ্যায়। সেখানে সে ভুলে যেতে বসে তার অস্তিত্ব। শুরু হয় তার জীবনসংগ্রামের অন্তিম আর কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রামী পালা। গোর্কি, মার্কস ছেড়ে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় রাঁধার পর বাড়া আর বাড়ার পর রাঁধা - এই জীবনে। নতুন জীবনের প্রতিটি দিন কাটে তার হাঁড়ির জলে হাত ডুবিয়ে। নতুন সংসারে এসে সব মেয়েরা যখন রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তখন সে নিজেকে পরিচিত করে নতুন বউ হিসেবে নয়, একজন দক্ষ সেবিকা হিসেবে। সাংসারিক কর্তব্যে আর রুগী সেবা করতে করতে ভুলে যায় সমস্ত রকম আমোদ আহ্লাদ। কিন্তু তাতে তার মন ভেঙে যায় না। কারণ সে যে শুধুই রক্তেমাংসে গড়া মানুষ হতে চায়নি। সে চেয়েছিল একজন আদর্শবাদী নারী হতে। যে মেয়ের শুধুমাত্র সংসারটা পুতুল খেলার না হয়ে, হয়ে উঠবে মানুষ গড়ার সংসার, মানুষ গড়ার কারখানা। সে নিজেও জানেনা সে আজ সফল কিনা - তবে তার অক্লান্ত পরিশ্রম বাস্তব রূপদানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। পারেনি একজন আদর্শ মায়ের মর্যাদা থেকে চ্যুত করতে। তাইতো সে মুখ বুজে অপেক্ষা করত সেই দিনটার - যে দিনটাতে সূর্য উঠবেই। এইভাবে নতুন সংসারেও সে হয়ে ওঠে অনিবার্য। তাকে শ্বশুড়বাড়িতে - অনেকটা যেন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতই তার অবস্থা হয়। কিন্তু কেউ তাকে আটকে রাখতে পারেনা। নিজের ভাল থাকা, ভাল খাওয়া আর ভাল পড়া কে বিসর্জন দিয়ে পরের জন্য বিসর্জন দেয় নিজেকে। সে বলে - জীবনটা শুধু নিজের জন্য নয় - এটুকু জীবনে কত কী করবার আছে। সে যে ছোট থেকেই বহুজন হিতায় বহুজন সেবায় : মন্ত্রে দীক্ষিত। রক্তের সম্পর্ক না থেকেও যে হয়ে ওঠে সংসারের প্রত্যেকের কাছে অপরিহার্য্য।
সমস্ত ক্ষেত্রেই তার মতামত, উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। তার ব্যাপ্তি হয়তো চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে কিন্তু তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে সাংসারিক কূটনীতিকে। সে তার সংগ্রামী সুবুদ্ধি দিয়ে জং ধরে যাওয়া সংসারকে টেনে নিয়ে গিয়েছে অনেক দূর তবু তার এই সংসার সংগ্রাম কিন্তু থেমে থাকে নি শুধুমাত্র তিনজনের মধ্যে। সে তার ঐ তেজোদ্দীপ্ত সংগ্রামী জীবনকে উৎসর্গ করতে কখনো পিছুপা হয়নি, একান্নবর্তী পরিবারের জন্য। তার নিরলস প্রচেষ্টাতেই পায়ের নীচের শক্ত ভিত খুঁজে পেয়েছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা - একদিন কিনা যারাই তাকে আখ্যায়িত করেছিল সেই দিনের স্বাধীনচেতা বউ বলে। কিন্তু সে যে মনে করে সে বোধহয় ভাগ্যহীনা দলের স্থায়ী সদস্যা। তবুও তার সংগ্রামী মন হার মানে না - হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে; তোমায় আমায় দেখা হবে সেই মিলনের পরে। তাই তার সংগ্রামী মনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি পারিপার্শ্বিক কীটানুকীটের দল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন একান্নবর্তী পরিবারেও সে নিজের আত্মসম্মান, পড়াশুনা, পরিশীলিত রূচিবোধের আর সর্বোপরি কর্তব্যপরায়ণতার জোরে নিজের আসন তৈরী করে নেয়। শুধুমাত্র বাড়ির সামাজিক রূপের সংস্কার করেই তার সংগ্রামী মন ক্ষান্ত থাকেনি। ধীরে ধীরে আশেপাশের প্রতিবেশীরাও তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। অসুখে বিসুখে, আপদে বিপদে, সেবা সুশ্রুষায়, তার অনমনীয়তার কাছে হার মেনে যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকারাও। আর তার সাথে চলতে থাকে অবৈতনিক শিক্ষাদানের কাজ - কারো বৌদি, কারো কাকিমা, কারো বা শুধুই দিদিমণি - এই পরিচয়েই তার সংগ্রামী জীবন ফুলে ফেঁপে ওঠে। জীবনসংসারের তাগিদে সে হয়তো অনেক কিছু মানিয়ে নেয় কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারেনা চটুতা, চপলতা আর মিথ্যাচারীতা। সে সব কিছু মেনে নিলেও মেনে নেয়নি পড়াশুনার সাথে কোনো রকম সমঝোতা। তার মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে মান - হুঁশ হতে হবে, চাই মানসিকতার উত্তরণ, দৃঢ় অথচ পরিশীলিত মানসিক গঠন। তাই শত বাধা সত্ত্বেও সে তার আত্মজাকে তৈরী করার চেষ্টা করে সমাজের একজন মান - হুঁশ বানাতে। ছোটবেলা থেকেই সেই চেষ্টায় ছিল না তার কোনো কার্পণ্য। একহাতে মেয়ের পড়ার বই আর অন্য হাতে মেয়ের বাবার সেবা আর তারই সাথে ছিল একান্নবর্তী পরিবারের প্রতি সুনিপূন কর্তব্যকর্ম - এভাবেই কাটত বেপরোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দামাল মেয়েটির জীবন। তবে সে কিন্তু কোনোদিন থেমে যায় নি, পরিশ্রান্ত হয়নি। ক্লান্তির হাত তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কোনো অবস্থাতেই। কারণ সে যে হারতে জানে না - তার নামের মধ্যে দিয়েই সে জগতকে ভোরের ঊষার আলোয় জাগাতে চায় - তার তো ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই। তাইতো সে একদিকে যেমন কর্তব্য নিষ্ঠাপরায়ণ বধূমাতা, অপরদিকে সেবাপরায়ণ স্ত্রী আর সেই সাথে অন্যদিকে কঠোর সত্যনিষ্ঠ অথচ স্নেহময়ী মা।
তবে আজও সে জানেনা সে সফল কিনা। সে হয়ত আজও বা ভেবে চলে - নতুন কিছু ভাবনার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে সে দেখতে পায় তার নিজের হাতে তৈরী করা পাল তোলা নৌকা এগিয়ে যায় পত্ পত্ করে। সে তার আত্মজার মধ্যে দিয়ে দেখতে পায় তার তৈরী করা ছোট্ট একখানি কুঁড়েঘরকে - সেখানে সে মায়ের মতো পিদিম জ্বালিয়ে বসে থাকে আর স্বপ্ন দেখে সুস্থ সবল সমাজের - সেখানে সুস্থ সুন্দর সত্যিকার মান - হুঁশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার অতি প্রিয় রতন তার আত্মজা।
জানোতো - গল্পটি কার - এই গল্পটি আমার গর্ভধারিনী মায়ের - এই সংগ্রামী জীবনের কিছুটা শোনা আর বেশীটাই যে আমার দেখা। এ দেখা আজও চলছে। আশা রাখি চলবে অনন্তকাল।
Jayatee Banerjee
আপনাদের মূল্যবান মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে নিচে রিপ্লাই বক্সে কম্মেন্ট করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের পরবর্তী পোস্ট প্রকাশিত হলে আপডেট পাওয়ার জন্য। ফলো এবং লাইক করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। পরবর্তী পোস্ট নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছি আপনাদের সামনে। ধন্যবাদ।
Please don’t hesitate to ask any question to let us know more about your requirements. We are always there to assist you to make you perform better.
No comments:
Post a Comment