নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ। "
চারিদিকে হানাহানি, কাটাকাটি, বড় রক্তাক্ত পাশব এসময়। এসময় বড় প্রয়োজন তোমার রবি ঠাকুর। তুমি যে আমার তথা যুগ-যুগান্তরের নারীদের না বলা কথার আশ্রয়। যুগোপযোগী যন্ত্রণাকে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন কল্পনায় নয়, জীবনের অভিজ্ঞতায়। তার কুমুদিনী, নন্দিনী, দামিনী, মৃণাল, বিমলা, সুভা, বিন্দু - গল্প উপন্যাস নাটকে এরাই যেন বলে উঠেছে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হবে। বাঁচতে হবে পোশাকে - আসাকে আধুনিক হয়ে নয়, পাড়াগাঁয়ের গ্রাম্য রতনের মতো আদায় করে নিতে হবে নিজের সম্ভ্রম - নিজস্ব অধিকার।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ সেসময়কার প্রেক্ষাপট এবং মেয়েদের অবস্থানে এক ঝকঝকে দর্পন। কবি বলতেন - "প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকানো" - সেই থেকেই শুরু। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পের প্রদীপটি জ্বালাবার আগেও তার সলতে পাকানো কাজ করে গেছেন অনেকেই। তবে যথার্থ অর্থে বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক শিল্পী তিনিই। কবিই প্রথম "ছোটগল্প" কথাটি ব্যবহার করেন। তবে রবীন্দ্রনাথের লেখা পঞ্চম গল্পটি কেবল তাঁরই রচিত প্রথম সার্থক ছোটগল্প নয় - বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসের ধারাতেও "দেনাপাওনা" প্রথম সার্থক ছোট গল্প।
গল্পগুচ্ছের পাতায় পাতায় রয়েছে অন্তরের বন্ধ দরজা খুলে মুক্ত হওয়ার বার্তা। তাইতো রবি ঠাকুর পিতৃসম মোদের অভিভাবকও বটে। আবার নারী হৃদয়ের গোপন প্রেমিক ও বটে। তাঁকে কি অনস্বীকার্য করা যায় ? না যায় না। ক্লান্ত শয্যায় তুমি আমার ঘুমপাড়ানি - তুমিই যে আমার তথা সারাবিশ্বের নারী কুলের শ্রেষ্ঠ বিনোদন - অনেক না বলা কথার আশ্রয়, না বলা ভাষার ব্যাপকতা।
রবিবাবুর গল্পগুচ্ছ - সে যেন নারীসমাজের কথামৃত, আর গীতার অস্ফুট বাণী। আজ স্মার্টফোনের দুনিয়ায় আমরা যে আধুনিকতার গর্ব করি ,তা বোধহয় রবীন্দ্রনাথ - তোমার আধুনিকতাকে ছুঁতে পারেনি। তোমার গিরিবালা সে যুগেও দর্পের সাথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। স্বামীর বাইরে বেরিয়ে পড়া মনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সে বাড়ি ছাড়ে। যে নাটকের দলের অভিনেত্রীর জন্য নিজের স্ত্রীকে ভুলে গিয়েছিলো গোপীনাথ, সেখানেই নিজের মোহময় সৌন্দর্য দিয়ে দর্শকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে। সেকারণেই পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্ম নিল আপন বাপ - মায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিলেন নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই , প্রায় ঠাকুর দেবতার নামই প্রচলিত ছিল........ "রামসুন্দর কে সান্ত্বনা দিবার সময় তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বিপুল বর্ণনা করিল.......... এবারে বিশ হাজার টাকা পন হাতে হাতে আদায় " - পুরুষের এটা বোধহয় সহজাত প্রবৃত্তি যে সে যুদ্ধ চায়। যুদ্ধে জিততেও চায়। হার মানতে নারাজ। সবসময়ই সে লড়াইয়ের ময়দানে উল্টোদিকে তার চাইতে দুর্বলকে প্রত্যাশা করে খুশী হয়, খুশী হয় বললে ভুল হবে, বলা যেতে পারে আত্মসুখে সুখী হয়।
গিরিবালা, নিরূপমার মতো কখন যেন আমরা ঘুরতে ঘুরতে চলে আসি কুসুম বনেতে - "ঘাট বলে - জলের উপরে যখন কুসুমের ছোট ছায়াটি পড়িত, তখন আমার সাধ যাইতো যে ছায়াটি যদি ধরিয়া পারি, সে ছায়াটি যদি আমার উপর পা ফেলিত ও তাহার চারগাছি মল বাজিতে থাকিত, তখন আমার শৈবাল গুল্মগুলি পুলিকিত হইয়া উঠিত"। এই কুসুম বিয়ের স্বরূপ জানার আগেই সাদা পোশাকে ভুষিত হোল - সে বুঝতেই পারল না - নববধূর সাজই বা কাকে বলে বা বৈধব্যই বা কি ? কিন্তু যখন কালের নিয়মে ছোট্ট বালিকা বিয়ের স্বরুপকে চিনতে পারলো - তখন সব শেষ কিন্তু তাতে কী হেলদোল ই বা হোল ওইটুকু মেয়ের।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে সমস্যা তৈরিতে ক্ষান্ত হননি। তার প্রতিবাদী কন্ঠ ধ্বনিত হয়েছে বার বার। তিনি হেরে যাননি। তিনি শিখিয়েছেন - এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথার যন্ত্রণা, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কতো মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কি, পৃথিবীতে কে কাহার............. স্ত্রীর পত্রে মেজ বউ এর প্রতিবাদী চরিত্র কিন্তু কুরুপার বাহু আস্ফালনের কাছেও হার মেনে যায়। কবি তুমি বারবার বলেছ - স্ত্রীলোক যেটা বুঝিতে পারেনা, হয় সেটার অস্তিত্ব বিলোপ করিয়া তাহার সহিত কোনো সম্পর্ক রেখো না, নয় তাহাকে স্বহস্তে নতুন মূর্তি দিয়া নিজের ব্যবহারযোগ্য একটি সামগ্রী গড়িয়া তোলে " - যদি দুইয়ের কোনোটিই না পারে, তবে তাহার উপর ভারী রাগ করিতে থাকে। মেয়েদের সম্পর্কে এই গভীর উপলব্ধি তাকে যেন অন্যমাত্রায় ভূষিত করে। তাঁর ভাষায় - "যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষা বিস্ফারিত নদী ধরণীর উদ্বেলিত অশ্রু রাশির মত চারিদিক ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটি বেদনা অনুভূত হইতে লাগিল, পালে যখন বাতাস লাগিল - মনে হইল এ পৃথিবীতে কে কাহার।"
আবার মেয়েটির নাম যখন সুভাষিনী রাখা হয়েছিল, তখন কে জানতো সে বোবা হবে ? কিন্তু সুভার বিয়ের পর যখন সে বুঝতে পারলো - "এবার তাহার স্বামী চক্ষু কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা পরীক্ষা করিয়া, এক ভাষা বিশিষ্ট কন্যা বিবাহ করিয়া আনিল। "
এসবের পরেও তুমি রবীন্দ্রনাথ - তুমি আত্মার আত্মীয় - আমার অজানা প্রেম রবি ঠাকুর তুমি - কিন্তু তোমার ভাষাতেই তোমাকে আমরা শুধু লালন - পালন করেই গেলাম, তোমাকে ধারণ পর্যন্ত করতে পারলাম না। তাইতো তুমি এখনো ঠাকুর - এখনো বোধ হয় পঁচিশে বৈশাখে ফুল-বেলপাতা দিয়ে পূজিত হও তুমি। তাই সমাজ রূপ তক্ষকের কাছে আমরা তথা আধুনিক নারীরা হার মেনে যাই। নিরুপমা হতে পারেনা হাবিব খাঁর পালিতা কন্যা কমলা - আবার বিন্দুকে তলিয়ে যেতে হয় কালের গর্ভে। কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শেখায় গিরিবালা।
যাদের তুমি প্রানের ভাষা শিখিয়েছো বা যুগিয়েছো সেই নারীদের চেতনোদয় করার দায়িত্ব যে তোমারি রবি ঠাকুর - তাই বারবার মনে হয় ১৫৭ তম জন্ম দিবসের প্রাক্কালে বসে - হে বন্ধু, চিরবিদায় নয় -
"বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝারে চিরদিন তারে ডেকে নিও
ভুলোনা তারে নিতে - তাকে ডেকে নিও।"
Jayatee Banerjee
যেকোনো রকম প্রশ্ন থাকলে আমাদের জানাতে দ্বিধা করবেন না। আমরা সর্বদা আপনাদের সহায়তায় সচেষ্ট।
আপনাদের মূল্যবান মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে নিচে রিপ্লাই বক্সে কম্মেন্ট করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের পরবর্তী পোস্ট প্রকাশিত হলে আপডেট পাওয়ার জন্য। ফলো এবং লাইক করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় , যুক্ত হন আমাদের facebook গ্রুপে। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। পরবর্তী পোস্ট নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছি আপনাদের সামনে। ধন্যবাদ।
Please don’t hesitate to ask any question to let us know more about your requirements. We are always there to assist you to make you perform better.
আপনাদের মূল্যবান মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে নিচে রিপ্লাই বক্সে কম্মেন্ট করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের পরবর্তী পোস্ট প্রকাশিত হলে আপডেট পাওয়ার জন্য। ফলো এবং লাইক করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় , যুক্ত হন আমাদের facebook গ্রুপে। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। পরবর্তী পোস্ট নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছি আপনাদের সামনে। ধন্যবাদ।
Please don’t hesitate to ask any question to let us know more about your requirements. We are always there to assist you to make you perform better.
No comments:
Post a Comment